সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চিকেন বিরিয়ানি রেসিপি বাংলা

 চিকেন বিরিয়ানি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় ও মুখরোচক খাবার। সুগন্ধি বাসমতী চাল, মসলা, দই, ঘি এবং মুরগির মাংসের অসাধারণ মিশ্রণে তৈরি এই খাবারটি শুধু পেট ভরায় না, বরং জিভে লেগে থাকে দীর্ঘ সময়। বাঙালি সংস্কৃতিতে বিরিয়ানি শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি আবেগের নাম। বিশেষ অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন কিংবা পারিবারিক আড্ডা – বিরিয়ানির উপস্থিতি সবকিছুকে আনন্দমুখর করে তোলে। বিশেষ করে চিকেন বিরিয়ানি অন্যান্য বিরিয়ানির তুলনায় সহজে রান্না করা যায় এবং তুলনামূলকভাবে হালকা হলেও স্বাদে কোনো অংশে কম নয়। এখন চলুন আমরা ধাপে ধাপে দেখে নেই কিভাবে ঘরোয়া উপকরণ ব্যবহার করে সুস্বাদু চিকেন বিরিয়ানি রান্না করা যায়, কী কী উপকরণ প্রয়োজন এবং রান্নার সময় কোন কোন কৌশল মেনে চলতে হয়।


প্রথমেই উপকরণ সাজানো জরুরি। চিকেন বিরিয়ানি রান্নার জন্য প্রধান উপকরণ হলো বাসমতী চাল বা বিরিয়ানি চাল, মুরগির মাংস, দই, পেঁয়াজ, টমেটো, আদা-রসুন বাটা, কাঁচা মরিচ, লাল মরিচ গুঁড়া, ধনে গুঁড়া, গরম মশলা গুঁড়া, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, জায়ফল, জাবিত্রী, জিরা, ঘি, দুধ, জাফরান বা ফুড কালার, লবণ এবং তেল। বাসমতী চাল বা বিরিয়ানি চাল ধুয়ে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা ভালো, এতে ভাত ফোলাফোলা হবে এবং ঝরঝরে আসবে। মুরগির মাংস মাঝারি সাইজের টুকরো করে ধুয়ে ভালোভাবে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এরপর মুরগির মাংসকে দই, আদা-রসুন বাটা, কাঁচা মরিচ কুঁচি, গরম মশলা গুঁড়া, লাল মরিচ গুঁড়া, ধনে গুঁড়া, লবণ ও সামান্য তেল দিয়ে মেখে ১ ঘণ্টা ম্যারিনেট করে রাখা উচিত। এই প্রক্রিয়ায় মুরগি নরম হয় এবং রান্নার সময় মসলার স্বাদ ভেতরে প্রবেশ করে।


চিকেন বিরিয়ানি রান্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পেঁয়াজ কুঁচি ভেজে বেরেস্তা তৈরি করা। গরম তেলে পেঁয়াজ সোনালি বাদামি রঙ না আসা পর্যন্ত ভেজে নিতে হবে। এই বেরেস্তা পরে ভাত ও মাংসে দেওয়া হলে এক অনন্য স্বাদ ও ঘ্রাণ তৈরি হয়। এখন ভাত রান্নার পালা। একটি বড় হাঁড়িতে পর্যাপ্ত পানি নিয়ে তাতে লবণ, তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ ও অল্প ঘি দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে। পানি ফুটে উঠলে ভেজানো চাল দিয়ে দিতে হবে এবং ৭০-৮০% সিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত রান্না করতে হবে। তবে চাল যেন বেশি সেদ্ধ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চাল ছেঁকে নিয়ে আলাদা রাখতে হবে।


এবার আসি মুরগি রান্নার প্রসঙ্গে। একটি বড় হাঁড়িতে বা কড়াইয়ে তেল ও সামান্য ঘি গরম করে তাতে গোটা মসলা (দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা) ফোড়ন দিতে হবে। এরপর আদা-রসুন বাটা দিয়ে নেড়ে মুরগির মাংস দিয়ে ভালোভাবে ভেজে নিতে হবে। মাঝারি আঁচে কিছুক্ষণ রান্না করার পর মাংস থেকে তেল আলাদা হয়ে আসবে এবং সুন্দর একটি রং হবে। প্রয়োজনে অল্প পরিমাণে পানি দিয়ে মাংস নরম করে নিতে হবে। মুরগির মাংস যখন প্রায় সেদ্ধ হয়ে যাবে, তখনই বিরিয়ানি তৈরির জন্য স্তর সাজানোর পালা শুরু হবে।


চিকেন বিরিয়ানি সাজাতে একটি বড় ও ভারী তলার হাঁড়ি ব্যবহার করা উত্তম। হাঁড়ির নিচে সামান্য ঘি মেখে নিতে হবে। প্রথমে সামান্য ভাত ছড়িয়ে দিতে হবে, তারপর মুরগির মাংস, এরপর বেরেস্তা, কাঁচা মরিচ কুঁচি, গরম মশলা গুঁড়া, ধনেপাতা ও পুদিনা পাতা ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর আবার ভাতের স্তর, তারপর মাংস, আবার ভাত – এভাবে কয়েকটি স্তরে সবকিছু সাজাতে হবে। সবশেষে ভাতের স্তর উপরে থাকবে। এরপর গরম দুধের সঙ্গে জাফরান বা ফুড কালার মিশিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। সামান্য ঘি ও বেরেস্তা ওপরে ছিটিয়ে হাঁড়ির মুখ টাইটভাবে ঢেকে দিতে হবে। চাইলে আটা দিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা সিল করে দেওয়া যায়, যাতে ভেতরের সুগন্ধ বেরিয়ে না যায়।


এখন হাঁড়িটিকে খুব কম আঁচে (দমে) রাখতে হবে প্রায় ২০-২৫ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে ভাত ও মুরগি একে অপরের স্বাদ শোষণ করে নিবে এবং অসাধারণ সুগন্ধ ছড়াবে। দমের সময় মাঝে মাঝে হাঁড়ির নিচে হালকা কাপড় বা তাওয়া দিয়ে দিতে পারেন, যাতে ভাত পুড়ে না যায়। নির্ধারিত সময় শেষে হাঁড়ির ঢাকনা খুললেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে চিকেন বিরিয়ানির অনন্য সুবাস। এরপর আলতো করে স্তর ভেঙে পরিবেশন করতে হবে।


চিকেন বিরিয়ানি সাধারণত পরিবেশন করা হয় সালাদ, রায়তা, সাদা সালাদ বা সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে। অনেকে শাহী টক দই বা কাবাবও সঙ্গে পরিবেশন করেন, এতে স্বাদ আরও বেড়ে যায়। বিরিয়ানির সঙ্গে শসা, টমেটো, পেঁয়াজের কাঁচা সালাদ কিংবা আচারও দারুণ মানায়।


এখন আসি কিছু বাড়তি কৌশলে। চিকেন বিরিয়ানি রান্নার সময় ভাত যেন ঝরঝরে থাকে, এজন্য ভাত ৭০% এর বেশি সিদ্ধ করা উচিত নয়। মাংস অবশ্যই ভালোভাবে মশলা মাখিয়ে রাখতে হবে, নইলে স্বাদ আসবে না। বেশি আঁচে ভাত দম দিলে নিচে লেগে যেতে পারে, তাই খুব কম আঁচ ব্যবহার করতে হবে। আবার চাইলে প্রেসার কুকার ব্যবহার করেও বিরিয়ানি রান্না করা যায়, তবে প্রচলিত হাঁড়িতেই আসল স্বাদ পাওয়া যায়।


চিকেন বিরিয়ানির বিশেষত্ব হলো এতে ঘি, মসলা ও মুরগির মাংসের অসাধারণ মিশ্রণ। এটি খেতে যেমন মজাদার, তেমনি শরীরের জন্যও পুষ্টিকর। মুরগির মাংসে রয়েছে প্রোটিন, যা শরীরের বৃদ্ধি ও শক্তি জোগাতে সহায়ক। বিরিয়ানির চাল শরীরকে দেয় কার্বোহাইড্রেট, যা শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। দই হজমে সাহায্য করে এবং মশলার মধ্যে যেমন দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ – এগুলো শরীরকে উষ্ণ রাখে ও হজমে সহায়ক ভূমিকা রাখে।


সবশেষে বলা যায়, চিকেন বিরিয়ানি এমন একটি খাবার যা শুধু খাওয়া নয়, খাওয়ার অভিজ্ঞতাকেও সমৃদ্ধ করে। বিরিয়ানির একেক কামড়ে মুরগির মাংস, মসলা, চাল, ঘি এবং জাফরানের সুগন্ধ মিলে এক অপূর্ব স্বাদের সৃষ্টি করে। এটি শুধু একটি রেসিপি নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে পরিবারের বিশেষ আয়োজন – সবকিছুরই প্রাণ হলো চিকেন বিরিয়ানি। ঘরে সামান্য যত্ন ও কৌশল মেনে চললে খুব সহজেই রেস্টুরেন্টের মতো চিকেন বিরিয়ানি রান্না করা সম্ভব। তাই বলা যায়, সুগন্ধি, ঝরঝরে ও মুখরোচক চিকেন বিরিয়ানি বাঙালি রসনার এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা শুধু ক্ষুধা নিবারণ নয়, বরং মনেরও তৃপ্তি এনে দেয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লিভার জন্ডিস হলে কি করনীয়

 লিভার জন্ডিস দূর করার উপায়: ঘরোয়া চিকিৎসা জন্ডিস কী এবং কেন হয় জন্ডিস বা কামলা রোগ আসলে কোনো আলাদা রোগ নয়, বরং একটি উপসর্গ। শরীরে বিলিরুবিন নামক এক ধরনের হলুদ রঞ্জক পদার্থ স্বাভাবিক মাত্রার বেশি বেড়ে গেলে চোখের সাদা অংশ, ত্বক এবং মূত্র হলুদ হয়ে যায়। লিভারের প্রধান কাজ হলো রক্ত বিশুদ্ধ রাখা, হজমে সহায়তা করা এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে ফেলা। যখন লিভার দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা কোনো কারণে এর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়, তখন বিলিরুবিন ভাঙতে পারে না এবং শরীরে জমে যায়, যা থেকে জন্ডিস দেখা দেয়। এর মূল কারণ হতে পারে হেপাটাইটিস ভাইরাস, অতিরিক্ত অ্যালকোহল, পিত্তনালীর বাধা, লিভার সিরোসিস, কিংবা দীর্ঘমেয়াদি লিভারজনিত অসুস্থতা। পর্যাপ্ত পানি পান: জন্ডিস হলে শরীরে পানিশূন্যতা দ্রুত বাড়ে। তাই দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি খাওয়া জরুরি। পানি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয় এবং লিভারকে চাপমুক্ত রাখে। পাশাপাশি ডাবের পানি, পাতলা স্যুপ, ফলের রস ও ভেষজ চা পান করা লিভারের জন্য উপকারী। বিশেষ করে আখের রস জন্ডিসে অত্যন্ত কার্যকর। আখের রস লিভারকে ঠান্ডা রাখে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সা...

বড়ই ফুলের মধু ও লিচু ফুলের মধুর মধ্যে কোনটি বেশ কার্যকর

  চমৎকার প্রশ্ন 🌸🍯 বরই ফুলের মধু (Sidr Honey) এবং লিচু ফুলের মধু (Lychee Flower Honey)—দুটোই স্বাস্থ্যসম্মত ও ভেষজ উপকারী, তবে কার্যকারিতা কিছু দিক থেকে আলাদা। --- 🍯 বরই ফুলের মধু (Sidr Honey) উপকারিতা: 1. দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি – অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। 2. গলা ও শ্বাসনালীর সমস্যা কমায় – কাশি, শুষ্ক কাশি, গলা ব্যথা। 3. শক্তি ও ক্লান্তি কমানো – হজমশক্তি বৃদ্ধি করে, শরীরকে সতেজ রাখে। 4. ত্বক ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি – ব্রণ ও ফুসকুরি কমায়, ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল করে। 5. যৌন স্বাস্থ্য বৃদ্ধি – প্রাকৃতিক কামোদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। ✅ মূলত এটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও যৌনশক্তির জন্য অত্যন্ত কার্যকর। --- 🌼 লিচু ফুলের মধু (Lychee Flower Honey) উপকারিতা: 1. শক্তি ও এনার্জি বৃদ্ধি – লিচুর স্বাদ ও গন্ধ শক্তি জোগাতে সহায়তা করে। 2. গলা ও শ্বাসনালীর আরাম – হালকা কাশি বা গলা ব্যথায় সহায়ক। 3. ত্বক ও হজমে সহায়ক – হালকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান আছে। 4. প্রাকৃতিক মিষ্টি ও রুচির জন্য জনপ্রিয় – স্বাদ মোলায়েম, মুখে মনোহর। ✅ মূলত এটি শরীরক...

নোটিশ সার্ভার এর কাজ কি

  ভূমিকা বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নোটিশ সার্ভারের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের সমন, তলবি কাগজপত্র বা নোটিশ যদি সঠিক সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে না পৌঁছে, তাহলে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। নোটিশ সার্ভার মূলত আদালত বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব নথি যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। তাই তাঁর কাজ শুধুমাত্র নথি পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং তা আইনসম্মত, সঠিক ও প্রমাণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করাই হলো প্রধান দায়িত্ব। --- নোটিশ সার্ভারের দায়িত্ব নোটিশ সার্ভারের প্রধান দায়িত্ব হলো— 1. আদালত বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রাপ্ত নোটিশ নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। 2. নোটিশ প্রদানের সময় ও স্থান সঠিকভাবে উল্লেখ রাখা। 3. নোটিশ গ্রহীতা নোটিশ গ্রহণ করেছেন কি না, তা রিপোর্টে উল্লেখ করা। 4. প্রয়োজনে সাক্ষীর উপস্থিতিতে নোটিশ প্রদান করা। 5. গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে বিচারিক কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলে। --- কাজের প্রক্রিয়া নোটিশ সার্ভারের কাজ সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু ধাপে সম্পন্ন হয়— 1. নো...